হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বতিকালীন সরকারের একশ দিন পার হলেও এখনো খাগড়াছড়ি শাসন করছে গোপালগঞ্জ ও ফ্যাসিবাদ শেখ হাসিনার আমলের কর্মকর্তারা। জেলা প্রশাসন, পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম টাস্কফোর্স ও সড়ক বিভাগে এখনো বহাল তবিয়তে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দোসররা। ফলে ব্যাহত হচ্ছে ছাত্র-জনতার সরকারের কর্মসূচী।
অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান অন্তর্বতিকালীন সরকারের কর্মসূচী বাস্তবায়নে খাগড়াছড়িতে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দোসররা নানা ভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান ২০২২ সালের ৪ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে তিনি ছিলেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রীর সাধন চন্দ্র মজুমদারের একান্ত সচিব।
মো. সহিদুজ্জামান ২৫তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য। তিনি গোপালগঞ্জ জেলার শাপলাডাঙ্গা উপজেলার অধিবাসী। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গভর্নমেন্ট এন্ড পলিটিক্স বিষয়ে বিএসসি ও এমএসসি পাশ করার পর ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন।
সূত্র বলছে, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার দলীয় প্রার্থীকে নিবিঘ্নে নির্বাচনী বৈতরী পার করানোর জন্য হাসিনা সরকারের অনুগত ও বিশ্বস্ত কর্মকর্তা হিসেবে মো. সহিদুজ্জামানকে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক হিসেবে বদলি করা হয়। অবশ্যই তিনিও হাসিনার অনুগত হিসেবে সেই কাজটিই করেছেন। যদিওবা নানা কূট-কৌশলের আশ্রয় নিলেও খাগড়াছড়ি সংসদীয় আসনে ১৯টি কেন্দ্রে শূন্য ভোট ও অন্তত ৫০ টি কেন্দ্রে ১ থেকে ২টির বেশি ভোট পড়েনি।
৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যওয়ার পর আত্মরক্ষার জন্য দেওয়াল টপকিয়ে খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়নে আশ্রয় নেন জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান। টানা প্রায় ৭দিন তিনি সেই রিজিয়নে ছিলেন।
আরও অভিযোগ রয়েছে, খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান অন্তর্বতিকালীন সরকারের কর্মসূচি বাস্তবায়নে নানামুখী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন।
অপরদিকে, শেখ হাসিনার আরও এক অনুগত কর্মকর্তা হচ্ছেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (উপ-সচিব) সুমন চৌধুরী। তিনি ২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে যোগদান করেন। তিনি ছিলেন হত্যাসহ একাধিক মামলার পলাতক আসামি সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মংস্ইুপ্রু চৌধুরীর শিক্ষকসহ হস্তান্তরিত বিভাগে নিয়োগ, ভুয়া প্রকল্প গ্রহণ ও খাদ্যসশ্যসহ বিভিন্ন খাতে হাজার হাজার কোটি আত্মসাতের সহযোগি এবং পরিকল্পনাকারী।
তারা দুজন ছাড়াও বৈষম্যমূলক পার্বত্য চুক্তির ফসল পার্বত্য চট্টগ্রাম অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু (পাহাড়ী ও বাঙ্গালী) নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্কফোর্সে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে নিয়োগ পাওয়া চেয়ারম্যান সুদত্ত চাকমা, চুক্তি ভিক্তিক নিয়োগ পাওয়া কৃষ্ণ চন্দ্র চাকমা ও প্রেশনে আসা নির্বাহী কর্মকর্তা রাশেদুল হক বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
কৃষ্ণ চন্দ্র চাকমা ২০১৯ সালে চুক্তি ভিক্তিক নিয়োগ পান। তার নিয়োগ আরও দুই দফা বাড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে ইতোমধ্যেই বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
অনুসন্ধান বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু (পাহাড়ী ও বাঙ্গালী) নির্দিষ্টকরণ ও পুনর্বাসন সম্পর্কিত টাস্কফোর্স ২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় কৃষ্ণ চন্দ্র চাকমাকে। এ কৃষ্ণ চন্দ্র চাকমা মূলত পোষ্টাল ক্যাডারের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি তৎকালীন পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ্যসচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার ব্যাচমেট। মূলত স্বজনপ্রীতির কারণে উপসচিব মর্যাদার এ কর্মকর্তা এ পর্যন্ত তিনবার দুই বৎসর করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ বাড়িয়ে টানা ৫ বছরের বেশি সময় ধরে একই দায়িত্ব পালন করে আসছেন। যার ৬ বছরের মেয়াদ শেষ হবে আগামি ২০২৫ সালের ২৭ এপ্রিল তারিখে।
আরেকজন হলেন প্রকৌশলী মো. মাকসুদুর রহমান। তিনি ২০২২ সালের ৯ নভেম্বর খাগড়াছড়ি সড়ক ও জনপদ বিভাগে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন।
অভিযোগ রয়েছে, চুয়েট থেকে পাশ করা মো. মাকসুদুর রহমান ছিলেন পলাতক সাবেক সড়ক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার দূর্নীতি ও অনিয়মের সহযোগী। মাকসুদুর রহমান সাবেক দুই মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর ঠিকাদারী সিন্ডিকেটের সকল অপকর্মের নায়ক। ফলে বিগত দিনে তাদের পছন্দের বাইরে কোনো ঠিকাদার সড়ক উন্নয়নে কোনো টেন্ডারেই অংশ নিতে পারেননি। এমনকি কোনো ঠিকাদার ভাগ্যক্রমে লটারিতে কাজ পেলেও কাজ করতে পারেননি।
অপরজন হলেন খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন ডা: মোহাম্মদ সাবের। তিনি পলাতক সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার দূর্নীতি ও অনিয়মের অন্যতম সহযোগী ছিলেন। স্বাস্থ্য বিভাগের ঔষধ সরবরাহ থেকে যাবতীয় সকল টেন্ডার হয়েছে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার ইচ্ছায় ও সিভিল সার্জন ডা: মোহাম্মদ সাবের সিদ্ধান্তে। ফলে খাগড়াছড়ির স্বাস্থ্য সেবা ভেঙ্গে পরার উপক্রম হয়েছে।
এ মুহূর্তে অন্তর্বতিকালীন সরকারের কর্মসূচি সফল বাস্তবায়নে গোপালগঞ্জ ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের অন্যত্র বদলি বা অপসারণের দাবি করছেন সচেতন মহল।