এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার পিপিএম।।
সেদিনের বিকেলটাও ঠিক এমনই ছিল।সিঁদুরে মেঘের লালচে আভায় পশ্চিমের আকাশটা যেন সাঁঝবাতি জ্বালিয়ে রেখেছে।আমি বাড়ি থেকে সামান্য দূরে মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে ক্যানভাসে রং ছড়িয়ে চলেছি বিভোর হয়ে,হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে কাঁধে হাত দিল আমার। চমকে উঠে তাকাতেই আরও বেশী চমকে গেলাম।
“আরে, তুমি? ”
রোদেলার মুখটা ঐ আলোতে অপূর্ব সুন্দর লাগছিল।মনে হল,ঠিক এমন একটা সময়ে কখনও দেখাহবে বলেই ওর এই নামটা রাখা হয়েছিলো!
“একটু আগেই এলাম।চাচীকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করতেই বলল এদিকে এসেছ তুমি। ”
“বাহঃ,দারুন হয়েছে তোমরা এসেছ।নইলে এই গ্রামের বাড়িতে এত বড় ছুটিটা কাটানো যেতো না। ”
“কি সুন্দর না চারদিক? কেমন একটা আলোয় ভরে আছে। তুমি ছবি আঁকছ বুঝি? ”
“চেষ্টা করছি প্রকৃতির এই রুপটাকে ধরে রাখতে। ”
“তুমি কিন্তু দারুন আঁকতে পার। ”
রোদেলা আমার এক চাচার মেয়ে। ওর বাবা আর আমার বাবা পরষ্পর চাচাত ভাই।যদিও আমাদের দুজনের পরিবারই কর্মসূত্রে ও আমাদের লেখাপড়ার জন্য পৃথক ভাবে ঢাকায় থাকে,আমরা যে কোনও বড় ছুটিতেই কিছুদিন অন্তত গ্রামের বাড়িতে এসে কাটাই।শহরে ব্যস্ততার কারনে তেমন একটা দেখা হয়না আমাদের।আর,রোদেলারও খুব বেশী আসা হয়নি আগে।
সন্ধ্যে হবে একটু পর। আমরা বিভিন্ন কথা বলতে বলতে বাড়ির দিকে ফিরে গেলাম।
মা কি একটা কাজ করছিলেন তখন।রোদেলা পিছন থেকে মা কে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো, “কি করছ চাচী? ”
“তোদের জন্য রাতের খাবার রান্না করতে হবে তো। ”
“আজ আমি করি? ”
“পাগলী,তোকে কষ্ট করতে হবে না। ”
“ছেলের বিয়ে দাও এবার।আর কত দিন তুমি রান্না করে খাওয়াবে? ”
“তোর মত একটা লক্ষী মেয়ে কোথায় পাই বল? ”
হঠাৎ করেই রোদেলার মুখে একটা অভূতপূর্ব চমক দেখতে পেয়েছিলাম তখন। ভালোলাগা, আনন্দ, কিছুটা ভয় আর অনেকটা লজ্জ্বা মেশানো এক মুখ,যা কখনই ভোলা যায়না।
পরদিন সকালেই রোদেলা এসে বায়না ধরল শর্ষে ক্ষেত দেখবে বলে। আমি বই পড়ছিলাম। বললাম শেষ করে যাব।কিন্তু ওর অতি উৎসাহে বইপড়া অসমাপ্ত রেখেই বের হতে হল।
“অসম্ভব রকমের সুন্দর না? আমাকে দুটো ফুল তুলে দাওনা। উফঃ,তুমি একেবারেই বুড়োদের মত গম্ভীর!”
আমি মুচকি হেসে দুটো ফুল তুলে দিলাম ওর হাতে।
বাতাস ওর চুল বারবার এলোমেলো করে দিচ্ছিল।
কিন্তু কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই।আমার হাত ধরে টানতে টানতে সামনের দিকে হাঁটছিল সে।কোনও এক অজানা শিহরনে আমি চমকে উঠছিলাম বারবার।
একটা বড় গাছের ছায়ায় এসে দুজনেই ঘাসের ওপর বসে পড়লাম। রোদেলাকে খুব খুশী দেখাচ্ছিল।আমার হঠাৎ মনে হল,ও অনেকটা বড় হয়ে গেছে! ঢাকায় যখনই ওর সাথে দেখা হয়েছে,কখনই এতটা উচ্ছ্বল মনে হয়নি। প্রকৃতি মানুষকে আরও সুন্দর করে দেয়।
“তুমি কি শুধুই ছবি আঁক,না কি কবিতাও লিখতে পার? ”
বললাম,”আমি কবিতা লিখতে পারি না।”
“কেন? দুটোইতো একই রকম। তুমি রং দিয়ে যেমন ছবি আঁক,ঠিক তেমনি করেই শব্দ দিয়ে আঁকবে! ”
“কঠিন কাজ। ”
“কবিরা নাকি অন্যদের মনের কথা বুঝতে পারে! ”
“নাহঃ, আমি কিছুই পারি না। ”
রোদেলা গভীর দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিলো। ঐ বাতাসের মধ্যেও আমি যেন ওর দীর্ঘশ্বাঃস শুনেছিলাম তখন।
কিছুক্ষন পর দুজনেই বাড়ির দিকে ফিরলাম।রোদেলা আর একটা কথাও বলেনি সেদিন।
কটা দিন আনন্দে কেটেছিল খুব। শহরে সবাই পৃথক হলেও গ্রামের বাড়িতে আমাদের এখনও একান্নবর্তী পরিবার।যখনই আমরা একত্রিত হই,উৎসবের মতো কাটে সময়গুলো।
ঐ দিনের পরথেকে রোদেলা আমার সাথে আর তেমন বিশেষ কোনও কথা বলেনি। ওর চোখে তীব্র একটা অভিমান দেখতে পেয়েছিলাম আমি।যতবারই চোখে চোখ পড়েছে,প্রত্যেকবার ওর বর্ষার মেঘের মত সজল চোখদুটো আমাকে কি যেন বলতে চেয়েছে অধীর হয়ে। নিজের উদাসীনতার দোহাই দিয়ে আমি সবকিছু বুঝতে পেরেও বুঝতে চাইনি সেদিন।শুধু যেদিন ওরা ফিরে যায়,রোদেলা অস্ফুট আমাকে বলেছিলো,”ভালো থেকো। ”
সেদিনও আমি আমার আবেগ কে প্রশ্রয় দিতে পারিনি। হয়তো নিজেকে নিয়েই কোনও এক অজানা কারনে শঙ্কিত ছিলাম খুব।
তারপর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে।রোদেলা এখন বিবাহসূত্রে প্রবাসী। কিন্তু,জীবনের সায়াহ্নে এসে এখনও আমি ভুলতে পারিনি সেদিনের রোদেলার সেই ব্যাথাভরা দৃষ্টি।ওর অব্যক্ত অভিপ্রায়।
এখনও আমি ওকে একবারও জিজ্ঞেস করতে পারিনি, “কেমন আছ তুমি? ”
শুধু ওকে জানাতে ভীষন ইচ্ছে করে-
“রোদেলা,এখন আমি কবিতা লিখতে পারি! “