রহিমা আক্তার রীমা।
আজ ২৮মার্চ,প্রতিবছর এই দিনটি আসলেই মনের ভিতর স্মৃতিচারণ হয় ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা সহ্য করার একটি দিনের কথা।
দিনটি ২০০০ সালের ২৮ মার্চ সদ্য কিশোরী থেকে যৌবনে পা রাখা এক নববধূ আমি।
সংসার কি বুঝার আগেই বছর না যেতেই গর্ভবতী হওয়া এবং নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সেই সন্তান কে গর্ভে লালন করা আর অপেক্ষা কবে ভূমিষ্ট হবে?
২৮ মার্চ ভোররাত থেকে প্রচন্ড প্রসববেদনা,আস্তে আস্তে ব্যাথা এতোই তীব্র হচ্ছে যে সহ্য করা সম্ভব না। কিন্তু কাউকে যে বলবো সেই সাহস হচ্ছিল না বা শোনার মতো কেউ ছিল না।
সকাল বেলা সাহেব জীবিকার তাগিদে বের হয়ে যায়, এখনকার মতো তখন হাতে-হাতে মোবাইল ছিল না যে কল করলেই চলে আসবে বা বাবার বাড়ি খবর দিবো মা-বোন চলে আসবে?
নিজেও বুঝতে পারছি না ব্যাথার কারণ,অনেকটা বোকাসোকা ছিলাম এসব ব্যপারে কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না,ঐদিন যে সন্তান ভূমিষ্ট হবে তাও বুঝতে পারিনি।
যৌথ পরিবার ছিল আমাদের। পরিবারের সদস্য মোটামুটি অনেকজনই ছিল তাই সকাল থেকে একাই রান্না করছি আর ব্যাথায় দুই চোখ গড়িয়ে পানি পরছে। তাও উঠানে রোদের মধ্যে পাতা দিয়ে রান্না করা।
বাসায় একমাত্র মুরুব্বি শ্বাশুড়ি কিন্তু উনি আমার এই সঙ্কটমুহুর্তে বাসায় ছিলেন না বেড়াতে গিয়েছিল উনার মেয়ের বাসায়। আর যারা ছিলেন বাসায় সবাই যারযার ঘরে।বাহিরে কেউ ছিল না তাই আমার পরিস্থিতি উপলব্ধিও করতে পারেনি।
সকালে রান্না করলাম দুপুরেও রান্না শেষ করলাম কোনমতে।
আর ব্যাথা এতটাই বেড়েছে হাউমাউ করে কাঁদতেও পারিনি কেউ শুনলে লজ্জা এজন্য!
কোনরকম গোসল করলাম কিন্তু নিজের পড়নের জামাটাও ধুইতে পারিনি।বিকেল গড়িয়ে আসছে রাতের রান্না করতে হবে কিন্তু আর সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাথার চেয়ে বেশি চিন্তা কিভাবে রান্না করবো?
খাবারের সময় হলে যদি রান্না না থাকে সবাই কি খাবে?
বিকেলে বাড়ির সামনে খোলা জায়গা সেখানে কাপড় দেওয়ার রশি ধরে দাঁড়িয়ে আছি মুখটা এতটাই মলিন দু-চোখ দিয়ে অবিরত পানি ঝরছে কি করবো দিশা পাচ্ছিলাম না?
যাহোক বিকেলে কেউ একজন ঘর থেকে বারান্দায় বের হয়ে আমার অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে এমন দেখাচ্ছে কেন?
আমি আমার পরিস্থিতি বললাম আর বললাম রান্নার সময় হয়েছে কিভাবে রান্না করবো?
উনি স্বান্তনা দিলো রান্না অন্য কেউ করবে কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে গেছে কেউ রান্না করার মতো নেই তাই নিজের দায়িত্ব এড়াতে পারিনি বলে নিজেই কোনমতে রান্না শেষ করলাম।
বাসায় টিএনটি ফোন ছিল আমার পরিস্থিতি বেশি খারাপ দেখে ননাসের বাসায় কল দিয়ে শ্বশুড়ী ও ননাসকে বিষয়টি জানানো হলে দুলাভাই তৎক্ষনাৎ উনাদের প্রাইভেটকার পাঠিয়ে দেয় আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য।
যখন গাড়ি আসে আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য তখনও আমি আমার কাপড় ধুই বাথরুমে,দুপুরে নিজের কাপড় ধোয়ার মতো শক্তি ছিল না।
যাহোক হাসপাতালে পৌঁছাতে রাত আটটা বেজে যায়,আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করে আমার সাথে দুজন হাসপাতালপ রেখে সাহেব সহ সবাই বাসায় চলে আসে।
সারাদিন ব্যথার কারণে তেমন কিছু খেতে পারিনি রাতেও কোন খাবার মিললো না। সারা রাত ব্যথায় ছটফট করেছি আর মাকে স্মরণ করেছি। একটা সন্তান জন্ম দিতে মায়েরা কত কষ্ট করে এটা একজন মাই বলতে পারবে।
জোরে কান্না করা যাবে না এতে লজ্জা, মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার জন্য বারবার মনে হচ্ছিল কেউ যদি একটু হাত বুলিয়ে দিতো হয়তো শান্তি পেতাম কিন্তু না সারারাত এভাবেই কেটে গেলো একা ব্যাথার সাথে লড়াই করে।
সকাল হলো আর সহ্য করতে পারছি না কিন্তু ডাক্তার আসতে দেরী হবে তাই আরও অপেক্ষা করতে হবে।
২৯ মার্চ সকাল ৮টায় ডাক্তার আসলো সাথে সাথে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হলো কিন্তু একটু পানিও খেতে পারিনি আগের দিন থেকে না খেয়ে আবার ব্যথায় গলা শুকিয়ে গেছে।বাবার বাড়ি খবর পৌঁছানো সম্ভব হয়নি তাই মাকে পেলাম না আর সাহেবও ওটিতে যাওয়ার আগে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেনি তাই অসহায়ের মতো হেটে চলে গেলাম। তখন মনে হয়েছে শেষ দেখা আর হবে না বুঝি আপনজনদের সাথে।
যখন ওটিতে ডাক্তার আপা ও নার্স সবাই কে অনুরোধ করছি আমাকে একটু পানি দেওয়ার জন্য কিন্তু উনারা পানি দিতে অপারগ বলছে আগে খাননি কেন এখন পানি দেওয়া সম্ভব না আপনার ক্ষতি হবে।আমি ডাক্তার আপাকে বারবার বলছি আপনি আমার ধর্মের মা হোন দয়া করে আমাকে একটু পানি দিন আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে পানি তৃষ্ণায়, অবশেষে একফোঁটা পানি দেওয়া হলো শুধু জিহবা ভিজানোর জন্য গলা অবধি পৌঁছায়নি পানি।
এখন বুঝি কতটা কষ্টে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে একটা মা সন্তান ভূমিষ্ট করে?
আগে প্রতিনিয়ত প্রসূতি মায়েরা সন্তান প্রসবকালে মারা যেতেন।এখন সচেতন হওয়ার কারণে হাসপাতালে নেওয়া হয় এজন্য মৃত্যুর হার কমে গেছে।
যাহোক সমস্ত যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে সকাল ৮:১৫ মিনিটে আল্লাহ আমার কোলজুড়ে এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান পাঠিয়েছেন।আলহামদুলিল্লাহ
যখন আমার ছেলে পৃথিবীতে আসলো এক মুহুর্তে সব কষ্ট ভুলে গেলাম।
ধবধবে সাদা, মাথা ভর্তি ঘনকালো চুল,সুডৌল নাক আর চুল এত লম্বা যে চুলগুলো নাক ও গাল ঢেকে রেখেছে।মনে হচ্ছে যেন রাজপুত্র,মাশা আল্লাহ।
আজ অবধি সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া কোন বাচ্চাকে আমি এত সুন্দর দেখিনি এখনো সেই চিত্র চোখের সামনে ভাসে। হয়তো নিজের সন্তানকে সব মায়েদের এমনই মনে হয়।
সকাল এগারোটার পর সাহেব হাসপাতালে আসলে হাসপাতালে সকল নিয়মকানুন শেষ করে। নরমাল ডেলিভারি হওয়ার কারণে ঐদিনই বাসায় চলে আসি।
সেই থেকে শুরু হলো নতুন লড়াই এ লড়াই সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার লড়াই।
কিশোরী বয়সে বিয়ে হওয়া,বছর না যেতেই সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া, সংসারের দায়িত্ব এককথায় জীবনে চলার পথটা সহজ ছিল না। তাছাড়া সাহেবের তেমন কোন উপার্জন ছিল না। তবুও নিজে কষ্ট করলেও ছেলেকে কোন অপ্রাপ্তি স্পর্শ করতে দেইনি।
ভালো স্কুল-কলেজ ও ভার্সিটিতে পড়ানো এবং প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছি।
অনেকটা হাতের মুঠোয় রেখে বড় করেছি এবং একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছি এতটুকু বলতে পারবো কিন্তু প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি বা পারবো কি না জানি না।
আল্লাহর কাছে রাতদিন শুকরিয়া আদায় করি সব সময়, আর দোয়া করি আমার ছেলের সফলতা যেন দেখে যেতে পারি। আল্লাহ সহায় হোন আমার ছেলের প্রতি।
ছেলে যদি বুঝতে পারে তবে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবে, ইনশাআল্লাহ।
(একজন মানুষ ৪৫ ইউনিট ব্যাথা একবারে সহ্য করতে পারে একজন মা যখন একটি শিশুকে জন্ম দেয়,তখন তিনি ৫৭+ ইউনিট ব্যাথা সহ্য করেন!!
এই ব্যাথা একসাথে ২০টি হাড্ডি ভেঙে যাওয়ার ব্যাথা থেকেও বেশি!!
সুতরাং মায়ের কষ্টের কি কোন প্রতিদান হয়?)